একতার প্রতিশ্রুতি—দ্রৌপদী, কৃষ্ণ, বুদ্ধ ও কোরআনের আলোকে মানবিক সমাজের খোঁজে

2 September 2025 • 18:43 0 মন্তব্য
একতার প্রতিশ্রুতি—দ্রৌপদী, কৃষ্ণ, বুদ্ধ ও কোরআনের আলোকে মানবিক সমাজের খোঁজে

একতার প্রতিশ্রুতি—দ্রৌপদী, কৃষ্ণ, বুদ্ধ ও কোরআনের আলোকে মানবিক সমাজের খোঁজে


 

আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি—পৃথিবীর এই সকল ধর্ম, দর্শন ও ইতিহাসের ভেতর দিয়ে কি কেউ আমাদের ডাকছে? কেউ কি বলতে চাইছে: “তোমরা ভিন্ন হতে পারো, কিন্তু বিভক্ত হও না”?


 

এক সময় আমি বিভক্ত চিন্তার মানুষ ছিলাম। ধর্মের মোড়কে আমি শুধু ‘আমার লোক’ খুঁজতাম, ‘অন্যকে’ নয়। কিন্তু জীবন যে সহজে শেখায় না, শেখায় ধাক্কা দিয়ে। আমার ছেলেই একদিন ঘরে নিয়ে এল একটি এতিম কুকুরছানা—একটি অবহেলিত প্রাণ, যাকে সমাজের চোখে পাপ, কিন্তু ওর চোখে ছিল ভালোবাসার নীরব ভাষা। নাম রাখা হলো ক্লারা। সেই ক্লারা আমাদের পরিবারে আসার পর বুঝলাম, করুণা, ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ—এসব কোনো ধর্মের একচেটিয়া সম্পদ নয়। এগুলো মানুষের চেতনার নিজস্ব জিনিস। এখান থেকেই শুরু হলো আমার যাত্রা—একতার সন্ধানে, যা আজ এই লেখায় পরিণত হয়েছে।


 

আমার চোখে, দ্রৌপদীর পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গে বিবাহ কোনো শারীরিক ব্যবস্থাপনার প্রতীক নয়। এটি একটি চেতনার ঐক্য। পাঁচটি ভিন্ন মন, ভিন্ন গুণ, ভিন্ন শক্তির সমন্বয়ে একটি নারীর সঙ্গে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া মানেই ভিন্নতার মাঝে একতার সাহস। দ্রৌপদী হয়ে ওঠেন সেই মাতৃ-রূপ, যিনি বিভাজনের ঊর্ধ্বে, আর পাণ্ডবরা প্রতীক হয়ে ওঠে আমাদের মানসিক বৈচিত্র্যের—জ্ঞান, ন্যায়, ধৈর্য, শক্তি ও সংবেদনশীলতার।


 

আমরা যদি দ্রৌপদী ও পাণ্ডবদের মতো সমঝোতা, দায়িত্ব ও সম্পর্কের এক অনন্য কাঠামো কল্পনা করতে পারি, তবে পারি মানব সমাজের জন্যও এমন একটি কাঠামো কল্পনা করতে—যেখানে আমরা ভিন্ন হয়েও এক হতে পারি।


 

এই দর্শনের পরিপূরক হিসেবে আমি যাদের সবচেয়ে গভীরভাবে অনুভব করি, তারা হলেন শ্রীকৃষ্ণ, গৌতম বুদ্ধ এবং মহানবী মুহাম্মদ (স.)—তিনটি আলাদা সময়, সমাজ ও ভাষার মানুষ, কিন্তু তাদের বার্তার মূলে ছিল একটাই কথা: “তুমি সচেতন হও, দায়িত্ববান হও, সহানুভূতিশীল হও।”


 

কৃষ্ণের কর্মযোগ


 

শ্রীকৃষ্ণ গীতা-রথে দাঁড়িয়ে অর্জুনকে বললেন:

“কর্মে মন দাও, ফলে নয়। কর্তব্যই ধর্ম।”


 

এই বার্তাটি আজো পৃথিবীর সবচেয়ে জরুরি দর্শন। কারণ আধুনিক সমাজে সবাই চায় ‘ফল’, কিন্তু দায়িত্ব নিতে চায় না কেউ। পরিবারে, রাষ্ট্রে, সমাজে—আমরা যদি নিজের কর্তব্যকে আগে রাখি, তবে ‘পরিবর্তন’ আর কল্পনা থাকবে না, তা বাস্তব হয়ে উঠবে।


 

বুদ্ধের করুণা ও আত্মজ্ঞান


 

বুদ্ধ বলেছেন:

“বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধম্মং শরণং গচ্ছামি, সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি।”

অর্থাৎ, নিজ বুদ্ধিকে আশ্রয় করো, নৈতিক পথকে গ্রহণ করো, সমাজের সঙ্গে একাত্ম হয়ে থেকো।


 

এই শিক্ষা যেন আজকের যুগের জন্যই বলা—যেখানে মানুষ নিজের বিবেক হারিয়ে ফেলছে, অন্ধ অনুসরণে নিজেকে খুইয়ে ফেলছে। যদি আমরা বুদ্ধের মতো আত্মজিজ্ঞাসা করি—“আমি কে? আমি কী চাই?”—তবে আমরা ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে মানবিক পরিচয়কে প্রাধান্য দিতে শিখব।


 

কোরআনের তাকওয়া ও ইনসাফ


 

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে:

“ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই। সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য সুস্পষ্ট।” (সূরা বাকারা :২৫৬)

আরও বলা হয়েছে:

“আল্লাহ তোমাদের আদেশ করেন ন্যায় ও সদাচরণের, এবং নিষেধ করেন অন্যায় ও দুরাচার থেকে।” (সূরা নাহল ১৬:৯০)


 

এই আয়াতগুলো শুধু ধর্মীয় ভাষ্য নয়—মানবিক ন্যায়ের ভিত্তি। কোরআনের প্রকৃত শিক্ষা তাকওয়া, ন্যায় ও সহনুভূতির শিক্ষা। হিংসা, ঘৃণা বা শক্তির অহংকার নয়।


 

আজ অনেকেই ধর্মের নামে মানুষের চোখে ঘৃণার চশমা পরায়। অথচ কোরআনের শিক্ষাই বলে—ন্যায়ের ভিত্তিতে কথা বলো, ভিন্ন বিশ্বাসের সঙ্গেও সহানুভূতিশীল হও।


 

একক মানবিক সমাজ – ভবিষ্যতের রূপরেখা


 

আমরা যদি এই তিন মহান পথপ্রদর্শকের আলোকধারা একত্র করি, তাহলে যে সমাজের কল্পনা দাঁড়ায়, সেটি হবে এমন:

• যেখানে ধর্ম নয়, কর্ম হবে পরিচয়

ভিন্নতা নয়, সহাবস্থান হবে শক্তি

করুণা ও দায়িত্ব হবে নাগরিকতার মাপকাঠি

• যেখানে পশুদের সঙ্গে নিষ্ঠুরতা হবে অপরাধ

• নারীর মর্যাদা ও প্রকৃতির রক্ষায় থাকবে সমাজের দায়িত্ব


 

এই সমাজে ধর্মীয় শিক্ষায় শেখানো হবে কেবল আচার নয়, আচরণ। শিশুরা মুখস্থ করবে না শুধু সুরা বা মন্ত্র—তারা শিখবে কীভাবে অন্যকে ভালোবাসতে হয়, কীভাবে প্রতিবেশীর কান্না শুনে নিজের হৃদয়ে রেখা কেটে যায়।


 

এই সমাজে মানুষ রাজনীতি করবে না ক্ষমতার জন্য, বরং সেবার জন্য

অর্থনীতি হবে শোষণের নয়, সহযোগিতার ভিত্তিতে।

শিক্ষা হবে চাকরির প্রস্তুতি নয়, চেতনাজাগরণের হাতিয়ার।


 

এই সমাজ শুরু হবে কোথা থেকে?


 

শুরু হবে তোমার-আমার মধ্য থেকে।

যখন আমরা ভিন্ন বিশ্বাসের মানুষকে অশ্রদ্ধা করব না

যখন আমরা পথের পশুকেও করুণা করব

যখন আমরা গরীবের প্রতি দায়িত্ব নেব

যখন আমরা বলব—“আমার ধর্ম আমাকে অহংকারী বানায়নি, বরং নম্র বানিয়েছে।”


 

তখনই গড়ে উঠবে সেই একক মানবিক সমাজ। সেটা কেবল একটি স্বপ্ন হবে না, হবে বাস্তবতা।


 

শেষ কথাটি এই—


 

যদি আমরা একসাথে ভাবতে পারি,

👉 দ্রৌপদী কেবল একজন নারী নন, একতার প্রতীক;

👉 কৃষ্ণ কেবল একজন দেবতা নন, দায়িত্বের প্রতিচ্ছবি;

👉 বুদ্ধ কেবল এক সাধক নন, আত্মজ্ঞান করুণার ভাষ্য;

👉 আর কোরআন কেবল এক ধর্মগ্রন্থ নয়, ন্যায়ের এক অনন্ত আহ্বান


 

তবে আমরা আসলেই পারি এক নতুন সমাজ গড়তে।

এই সমাজ হবে না কারো একক সম্পত্তি।

এটি হবে সকল হৃদয়ের মিলনস্থল—

একটি এমন পৃথিবী,

যেখানে একজন এতিম কুকুরছানাও হতে পারে পরিবর্তনের দূত।


 

✍️ [আবদুর রব লিখন]

লেখক, চিন্তাশীল নাগরিক ও মানবিক সমাজে বিশ্বাসী।

কলাম
0
জন পছন্দ করেছেন

মন্তব্য (0)

কোনো মন্তব্য নেই