ডেভিড হিউমের জ্ঞানতত্ত্ব (Epistemology)

3 September 2025 • 20:40 0 মন্তব্য
ডেভিড হিউমের জ্ঞানতত্ত্ব (Epistemology)

ডেভিড হিউমের (David Hume, ১৭১১-১৭৭৬) জ্ঞানতত্ত্ব (Epistemology) অভিজ্ঞতাবাদ (Empiricism) এবং সংশয়বাদ (Skepticism)-এর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে মানুষের সমস্ত জ্ঞান ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা থেকে উৎপন্ন হয় এবং আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। হিউমের জ্ঞানতত্ত্ব প্রধানত তার গ্রন্থ “এ ট্রিটিস অফ হিউম্যান নেচার” (A Treatise of Human Nature, ১৭৩৯-৪০) এবং “এনকোয়ারি কনসার্নিং হিউম্যান আন্ডারস্ট্যান্ডিং” (An Enquiry Concerning Human Understanding, ১৭৪৮)-এ বিশদভাবে বর্ণিত। নীচে তার জ্ঞানতত্ত্বের মূল ধারণাগুলো বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:

১. ইমপ্রেশন ও আইডিয়া (Impressions and Ideas)

হিউমের জ্ঞানতত্ত্বের কেন্দ্রীয় ধারণা হলো মানুষের মনের উপলব্ধিগুলোকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা:

•  ইমপ্রেশন (Impressions): এগুলো হলো প্রত্যক্ষ, প্রাণবন্ত এবং তাৎক্ষণিক ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা। যেমন, সূর্যের উত্তাপ অনুভব করা, একটি লাল ফুল দেখা, বা ব্যথা অনুভব করা। ইমপ্রেশন হলো জ্ঞানের প্রাথমিক উৎস।

•  আইডিয়া (Ideas): এগুলো হলো ইমপ্রেশনের ফিকে প্রতিচ্ছবি বা স্মৃতি, যা আমরা চিন্তার মাধ্যমে গঠন করি। যেমন, গতকাল দেখা একটি ফুলের কথা মনে করা বা কোনো অতীত অভিজ্ঞতার ধারণা।

হিউম বলেন, সমস্ত আইডিয়া ইমপ্রেশন থেকে উৎপন্ন হয়। কোনো আইডিয়া যদি কোনো ইমপ্রেশনের সঙ্গে সম্পর্কিত না হয়, তবে তা অর্থহীন। উদাহরণস্বরূপ, আমরা ঈশ্বর বা আত্মার ধারণা তৈরি করতে পারি, কিন্তু যদি এর পেছনে কোনো প্রত্যক্ষ ইমপ্রেশন না থাকে, তবে সেটি শুধু কল্পনার ফসল।

২. কার্যকারণ সম্পর্ক (Causality)

হিউমের জ্ঞানতত্ত্বের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং বৈপ্লবিক অবদান হলো কার্যকারণ সম্পর্কের উপর তার সংশয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি বলেন:

•  আমরা কারণ ও ফলের মধ্যে কোনো প্রকৃত বা প্রয়োজনীয় সম্পর্ক প্রত্যক্ষ করি না। বরং, আমরা শুধু দুটি ঘটনার ধারাবাহিকতা (constant conjunction) দেখি। উদাহরণস্বরূপ, আমরা দেখি যে বিলিয়ার্ডের একটি বল অন্যটিকে ধাক্কা দিলে দ্বিতীয় বলটি সরে যায়। কিন্তু আমরা শুধু এই দুটি ঘটনা একসঙ্গে ঘটতে দেখি, কারণ-ফলের কোনো “প্রয়োজনীয়” সম্পর্ক দেখি না।

•  এই ধারণা আমাদের মনের অভ্যাস (habit) থেকে উৎপন্ন হয়। আমরা বারবার একটি ঘটনার পর আরেকটি ঘটনা দেখে এই সম্পর্ক ধরে নিই। উদাহরণস্বরূপ, আমরা ধরে নিই সূর্য উঠলে দিন হবে, কিন্তু এটি শুধু অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতার ফল, কোনো যুক্তিগত নিশ্চয়তা নয়।

•  এই সংশয়বাদ বিজ্ঞানের ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, কারণ বিজ্ঞান কার্যকারণ সম্পর্কের উপর নির্ভর করে।

৩. ইন্ডাকশনের সমস্যা (Problem of Induction)

হিউম ইন্ডাকশনের (Induction) সমস্যা উত্থাপন করেন, যা জ্ঞানতত্ত্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তিনি বলেন:

•  আমরা অতীতের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দিই (ইন্ডাকশন)। যেমন, আমরা ধরে নিই যে কাল সূর্য উঠবে, কারণ এটি প্রতিদিন ঘটেছে।

•  কিন্তু এই ধরে নেওয়ার কোনো যুক্তিগত ভিত্তি নেই। অতীতের ধারাবাহিকতা ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দেয় না। এটি শুধু আমাদের মনের অভ্যাস।

•  এই ধারণা পরবর্তী দার্শনিকদের, বিশেষ করে কার্ল পপারের বিজ্ঞান দর্শনকে প্রভাবিত করে।

৪. সংশয়বাদ (Skepticism)

হিউমের জ্ঞানতত্ত্ব গভীরভাবে সংশয়বাদী। তিনি বলেন:

•  আমাদের জ্ঞান ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল, তাই এটি সবসময় নিশ্চিত বা পূর্ণাঙ্গ নয়।

•  কিছু বিষয়, যেমন ঈশ্বর, আত্মা, বা বাহ্যিক জগতের অস্তিত্ব, আমাদের জ্ঞানের বাইরে। কারণ এগুলোর কোনো প্রত্যক্ষ ইমপ্রেশন আমাদের নেই। উদাহরণস্বরূপ, আমরা বাহ্যিক জগতের অস্তিত্ব ধরে নিই, কিন্তু আমরা শুধু আমাদের ইন্দ্রিয়ের ইমপ্রেশন জানি, জগতের স্বরূপ নয়।

•  তবে, হিউম “মাঝারি সংশয়বাদ” (moderate skepticism) প্রচার করেন। তিনি বলেন, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই সংশয়বাদকে উপেক্ষা করে ব্যবহারিকভাবে কাজ করতে হয়।

৫. জ্ঞানের শ্রেণিবিভাগ

হিউম জ্ঞানকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করেন:

•  রিলেশন অফ আইডিয়াস (Relation of Ideas): এগুলো যুক্তিগত বা গাণিতিক সত্য, যেমন “২+২=৪” বা “সমস্ত ত্রিভুজের কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রি।” এগুলো অভিজ্ঞতা ছাড়াই সত্য এবং নিশ্চিত।

•  ম্যাটারস অফ ফ্যাক্ট (Matters of Fact): এগুলো ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে, যেমন “আকাশ নীল” বা “সূর্য পূর্বে উঠে।” এগুলো নিশ্চিত নয়, কারণ এর বিপরীত সম্ভব।

৬. হিউমের জ্ঞানতত্ত্বের প্রভাব

•  কান্টের উপর প্রভাব: হিউমের কার্যকারণ সম্পর্কের সংশয়বাদ কান্টকে তার “কপার্নিকান বিপ্লব” তৈরি করতে উদ্বুদ্ধ করে। কান্ট বলেন, হিউম তাকে “দোর্মিত দৃষ্টিভঙ্গি” থেকে জাগ্রত করেছেন। কান্ট হিউমের সংশয়বাদের জবাবে বলেন যে কার্যকারণ মনের একটি সহজাত ক্যাটাগরি।

•  বিজ্ঞানের দর্শন: হিউমের ইন্ডাকশনের সমস্যা আধুনিক বিজ্ঞানের দর্শন, বিশেষ করে পপারের ফলসিফিকেশন তত্ত্বকে প্রভাবিত করে।

•  আধুনিক দর্শন: হিউমের অভিজ্ঞতাবাদ ও সংশয়বাদ লজিক্যাল পজিটিভিজম এবং বিশ্লেষণাত্মক দর্শনের উপর গভীর প্রভাব ফেলে।

৭. হিউম ও কান্টের জ্ঞানতত্ত্বের তুলনা

যেহেতু আপনি কান্ট সম্পর্কেও জিজ্ঞাসা করেছেন, হিউম ও কান্টের জ্ঞানতত্ত্বের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো:

•  জ্ঞানের উৎস: হিউম বলেন, সমস্ত জ্ঞান ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা থেকে আসে, যেখানে কান্ট বলেন, মনের সহজাত কাঠামো (যেমন, স্থান, সময়, ক্যাটাগরি) জ্ঞান গঠনে ভূমিকা রাখে।

•  কার্যকারণ: হিউম কার্যকারণকে অভ্যাসের ফল বলে সংশয় প্রকাশ করেন, কিন্তু কান্ট বলেন, কার্যকারণ মনের একটি সহজাত ক্যাটাগরি।

•  জ্ঞানের সীমা: হিউম জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার উপর জোর দেন এবং সংশয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন। কান্ট সীমাবদ্ধতা স্বীকার করলেও ফেনোমেনা ও নুমেনার মধ্যে পার্থক্য করে জ্ঞানের একটি কাঠামো দেন।

0
জন পছন্দ করেছেন

মন্তব্য (0)

কোনো মন্তব্য নেই