সহজ সত্য, জটিল মানুষঃ বিশ্বাস, অবিশ্বাস ও মানবতার ভবিষ্যৎ

12 September 2025 • 14:05 0 মন্তব্য
সহজ সত্য, জটিল মানুষঃ বিশ্বাস, অবিশ্বাস ও মানবতার ভবিষ্যৎ

সহজ সত্য, জটিল মানুষঃ বিশ্বাস, অবিশ্বাস ও মানবতার ভবিষ্যৎ 
 

মানুষ ইতিহাসের এক দীর্ঘ যাত্রাপথে বারবার একটি প্রশ্নে ফিরে এসেছে— সত্য কি? আর সত্য যদি সর্বজনীন হয়, তবে আমরা কেন বারবার বিভ্রান্ত হই? কেন বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে পড়ে মানুষ পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, জাতি জাতির বিরুদ্ধে লড়ে, এমনকি ঈশ্বরের নামে যুদ্ধ করে? এই প্রশ্নগুলোই মানব সভ্যতার অন্যতম গভীর প্রশ্ন, এবং দর্শনের ইতিহাস এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে চলার এক দীর্ঘ নথি।
 

বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের দোলাচল

 

মানুষের মন বড়ই অদ্ভুত। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, কিন্তু প্রশ্নও করতে চাই। একদিকে বিশ্বাস আমাদের মানসিক নিরাপত্তা দেয়— আমরা মনে করি, কোনো এক পরম সত্য আছে যা আমাদের জীবনের অর্থ দেবে। অন্যদিকে অবিশ্বাস আমাদের মুক্তি দেয়— আমরা প্রশ্ন করার, চিন্তা করার, স্বাধীনভাবে বাঁচার সাহস পাই।
 

এই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল মানবসভ্যতার ইতিহাসকে গড়ে তুলেছে। সক্রেটিস এথেন্সের রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেছেন— “সত্য কী?” আর সেই প্রশ্নের জন্য তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। প্লেটো সেই মৃত্যুর বেদনাকে রূপান্তরিত করেছেন এক দার্শনিক সংলাপে, যেখানে তিনি দেখিয়েছেন সত্যকে উপলব্ধি করতে হলে মানুষকে ইন্দ্রিয়ের সীমা অতিক্রম করে ‘আইডিয়া’র জগতে প্রবেশ করতে হবে।

 

এরিস্টটল এসে প্লেটোর বিমূর্ত চিন্তাকে বাস্তবের মাটিতে নামিয়েছেন। তিনি বলেছেন— সত্য খুঁজতে হলে প্রকৃতির নিয়ম ও পর্যবেক্ষণকে গুরুত্ব দিতে হবে। পরবর্তী কালে কপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন— সবাই সেই পর্যবেক্ষণ ও প্রমাণের পথ ধরে প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন করেছেন।

 

কিন্তু একই সময়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের একাংশ এই অনুসন্ধানকে ভয় পেয়েছে। কারণ মানুষ যদি নিজে সত্য আবিষ্কার করে ফেলে, তবে ধর্মীয় কর্তৃত্ব টিকবে কীভাবে? ফলস্বরূপ বিজ্ঞানীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে, দার্শনিককে নির্বাসিত হতে হয়েছে। ইতিহাসে আমরা দেখেছি— যে সত্য মানুষকে মুক্ত করতে পারে, সেই সত্যকে আড়াল করতে কিছু শক্তি সর্বদা সক্রিয় থেকেছে।
 

প্রতীকী ভাষার প্রয়োজনীয়তা
 

তাহলে কি উপমা, প্রতীক, রূপক— এসবই সত্যকে আড়াল করে? একেবারেই নয়। উপমার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। মানুষের ভাষা সীমাবদ্ধ; অসীম সত্যকে ধরতে হলে তাকে সীমিত শব্দে প্রকাশ করতে হয়। তাই নবী-রাসুলরা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন, কবিরা রূপক ব্যবহার করেছেন, দার্শনিকরা প্রতীকী গল্প বলেছেন।

 

কোরআন নিজেই বলে— এতে রয়েছে “মুতাশাবিহাত” অর্থাৎ উপমা ও প্রতীক। বৌদ্ধধর্মে বুদ্ধ বলেছেন— “আমার শিক্ষা নদী পার হওয়ার নৌকার মতো। নদী পার হলে নৌকাকে আর মাথায় তুলে নিয়ে ঘুরবে না।” অর্থাৎ উপমা সত্যে পৌঁছানোর মাধ্যম, কিন্তু সত্য নয়।

 

সমস্যা শুরু হয় যখন আমরা উপমাকেই সত্য ধরে বসি। প্রতীক তখন ইঙ্গিত না হয়ে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়। একটি আঙুল যদি চাঁদের দিকে ইঙ্গিত করে, বুদ্ধ বলেছিলেন— “মূর্খ মানুষ আঙুলটিকেই পূজা করতে শুরু করে।” ইতিহাসে এমনটাই ঘটেছে। ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি— সবখানেই প্রতীকের পূজা হয়েছে, অথচ যে সত্যের দিকে প্রতীক নির্দেশ করছিল, তা আড়াল হয়ে গেছে।
 

বিশ্বাসের ব্যবসা ও বিভাজন
 

এখানেই শুরু হয় বিশ্বাসের ব্যবসা। কিছু মানুষ বিশ্বাসকে ব্যবহার করে নিজেদের আখের গুছিয়েছে। কেউ বলেছে— শুধু আমার ধর্মই সত্য, অন্যরা মিথ্যা। কেউ বলেছে— শুধু আমার জাতিই শ্রেষ্ঠ, অন্যরা নিকৃষ্ট। এর ফলে মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে বিভাজন তৈরি হয়েছে। বিশ্ব শান্তি নষ্ট হয়েছে, যুদ্ধ হয়েছে, রক্তপাত হয়েছে।
 

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক ক্ষমতা, এমনকি দর্শনের স্কুলও কখনো কখনো মানুষের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েছে। বিশ্বাসকে শক্তির হাতিয়ার বানানো হয়েছে, আর অবিশ্বাসকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। অথচ প্রকৃত দর্শন বলছে— বিশ্বাস ও অবিশ্বাস দুটিই প্রয়োজন। বিশ্বাস আমাদের যাত্রা শুরু করতে সাহায্য করে, আর প্রশ্ন আমাদের যাত্রাকে সঠিক পথে রাখে।
 

সত্যের মনস্তাত্ত্বিক দিক
 

সত্য উপলব্ধি করা কেবল একটি বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ নয়— এটি মনস্তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক কাজও বটে। একজন মানুষ যদি অন্তরের ভয়, অহংকার, হিংসা ও বিদ্বেষ থেকে মুক্ত না হন, তবে তার চোখ খোলা থাকলেও সে সত্যকে দেখতে পায় না। জন্মান্ধ যেমন আলো দেখতে পারে না, তেমনি মনস্তাত্ত্বিকভাবে অন্ধ মানুষও সত্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়।

 

মনোবিজ্ঞান বলছে— মানুষের মন প্রায়ই “কগনিটিভ ডিসোন্যান্স” বা দ্বন্দ্বে ভোগে। আমরা এমন তথ্য মেনে নিতে চাই না যা আমাদের বিশ্বাসকে নাড়িয়ে দেয়। ফলে আমরা বেছে বেছে সত্য গ্রহণ করি। কিন্তু আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে সত্যকে গ্রহণ করতে হলে আমাদের পুরো সত্তাকে প্রস্তুত করতে হয়।
 

আধ্যাত্মিক দিক ও সত্য উপলব্ধি
 

আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য বলছে— সত্য উপলব্ধির জন্য মনকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। সুফিবাদ বলে— হৃদয় যদি আয়নার মতো স্বচ্ছ হয়, তবে তাতে সত্য প্রতিফলিত হয়। বুদ্ধ বলেছেন— মন যদি প্রশান্ত হয়, তবে জিনিসগুলোকে আমরা যেমন আছে তেমন দেখি। খ্রিস্ট বলেছেন— “Blessed are the pure in heart, for they shall see God.”

অর্থাৎ সত্য বোঝা মানে শুধু তথ্য জানা নয়, বরং নিজেকে এমন অবস্থায় নিয়ে যাওয়া যেখানে সত্যকে অনুভব করা যায়।
 

উপসংহারঃ সহজ সত্যের পথে
 

সত্য কখনো জটিল ছিল না, জটিল আমরা নিজেরাই। সূর্যের আলো যেমন প্রতিদিন উদিত হয়, সত্যও প্রতিদিন আমাদের চারপাশে প্রকাশিত। কিন্তু আমরা চোখ বন্ধ করে রাখি, কিংবা চোখ খোলা রেখেও পর্দার আড়ালে তাকাই।

 

আজকের পৃথিবীতে যখন বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের সংঘাত চরমে, তখন আমাদের দরকার নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি— যেখানে বিশ্বাস আমাদের সংযুক্ত করবে, বিভাজিত করবে না; যেখানে অবিশ্বাস আমাদের প্রশ্ন করতে শিখাবে, ধ্বংস নয় বরং নির্মাণ করবে।

 

একক স্রষ্টার অসংখ্য সৃষ্টির যে কোনো একটি সৃষ্টির দিকে যদি আমরা গভীরভাবে তাকাই— একটি শিশুর হাসি, একটি পাখির গান, একটি বৃক্ষের ছায়া— তবে আমরা উপলব্ধি করতে পারি, সত্য কখনো দূরে নয়।

 

সত্য উপলব্ধির জন্য দরকার কেবল সরল দৃষ্টি, মুক্ত মন, আর অনুভব করার সাহস। যখন মানুষ এই সাহস অর্জন করবে, তখন আর কোনো ধর্ম, দর্শন বা রাজনৈতিক মতবাদকে বিভেদের হাতিয়ার বানানো যাবে না। তখন বিশ্বাস আর অবিশ্বাস খেলনা হবে না, বরং মানবতার অগ্রযাত্রার দুইটি ডানা হয়ে উঠবে।

 

প্রবন্ধ
0
জন পছন্দ করেছেন

মন্তব্য (0)

কোনো মন্তব্য নেই