আইনস্টাইনের ‘Cosmic Religious Feeling’ ও “ভ্রান্তি থেকে প্রজ্ঞা”র দার্শনিক মিলন
আইনস্টাইনের ‘Cosmic Religious Feeling’ ও “ভ্রান্তি থেকে প্রজ্ঞা”র দার্শনিক মিলন
মানবচিন্তার ইতিহাসে এমন কিছু ব্যতিক্রমী মুহূর্ত আছে, যখন বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতা একে অপরের হাত ধরে চলে। আলবার্ট আইনস্টাইনের Cosmic Religious Feeling সেই মুহূর্তগুলির একটি—যেখানে মহাবিশ্বের শৃঙ্খলা, সৌন্দর্য ও রহস্য মানুষের মধ্যে এক গভীর বিস্ময় ও শ্রদ্ধার জন্ম দেয়। এই অনুভূতি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বা ব্যক্তিগত ঈশ্বরের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ নয়; বরং এটি জন্ম নেয় সেই মুহূর্তে, যখন মানুষ মহাবিশ্বকে উপলব্ধি করতে চায়, নিজের ক্ষুদ্রতা ও মহাজাগতিক মহিমার একাত্মতা অনুভব করে।
আইনস্টাইন ব্যাখ্যা করেছিলেন যে মানব ধর্মীয় অনুভূতির তিনটি স্তর রয়েছে। প্রথম স্তরে মানুষ প্রকৃতির ভয় থেকে ঈশ্বর বা দেবদেবীর ধারণা তৈরি করে—অজানা বিপদ থেকে মুক্তির আশায়। দ্বিতীয় স্তরে মানুষ নৈতিক ঈশ্বরের কল্পনা করে—যিনি পুরস্কার দেন, শাস্তি দেন, ন্যায়বিচার করেন। কিন্তু সর্বোচ্চ স্তরটি হলো Cosmic Religious Feeling, যেখানে ব্যক্তিগত ঈশ্বরের ধারণা বিলীন হয়ে যায়। সেখানে রয়ে যায় কেবল মহাবিশ্বের অনিবার্য শৃঙ্খলার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও বিস্ময়। বিজ্ঞানীর অবিরাম অনুসন্ধান, দার্শনিকের চিন্তা বা শিল্পীর অন্তর্দৃষ্টি—সবই এই অনুভূতির ফলশ্রুতি। আইনস্টাইনের মতে, এটাই সত্যিকার আধ্যাত্মিকতা।
ঠিক এই জায়গাতেই “ভ্রান্তি থেকে প্রজ্ঞা” বইটির দর্শন এসে দাঁড়ায়। গ্রন্থটি দেখায়, মানবসভ্যতার বড় সংকট হলো তার ভ্রান্তি—ধর্ম, জাতি ও মতাদর্শের বিভাজন, যা মানুষকে সংকীর্ণ করে। কিন্তু প্রজ্ঞার পথে যাত্রা শুরু হয় তখনই, যখন মানুষ সাহস করে প্রশ্ন তোলে, অন্ধ আনুগত্য ছেড়ে সত্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। এই বইটি শুধু ব্যক্তিগত মুক্তির কথা বলে না, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য এক নতুন দিগন্তের কথা বলে—যেখানে মানুষ মহাবিশ্বের প্রাকৃতিক নিয়মের সাথে নিজেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে এবং একক মানব সমাজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যায়।
আইনস্টাইনের Cosmic Religious Feeling ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার গভীরতা প্রকাশ করে—মহাবিশ্বের সামনে বিনয়ী হওয়ার আহ্বান জানায়। “ভ্রান্তি থেকে প্রজ্ঞা” সেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে সামাজিক ও নৈতিক পরিসরে প্রসারিত করে। এখানে সত্য অনুসন্ধান শুধু বৈজ্ঞানিক অনুশীলন নয়, বরং এক মানবিক দায়িত্ব। মহাবিশ্বের নিয়ম কেবল গণিতের সূত্র নয়, বরং নৈতিক দিকনির্দেশনা। ঐক্য কেবল এক অনুভূতি নয়, বরং এক রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গীকার।
উভয়ের দর্শন শেষ পর্যন্ত একই স্থানে এসে মিলিত হয়—অহংকার ভেঙে বৃহত্তর সত্যের সামনে আত্মসমর্পণ করা। আইনস্টাইনের ভাষায়, “সবচেয়ে সুন্দর অভিজ্ঞতা হলো রহস্যকে অনুভব করা।” আর “ভ্রান্তি থেকে প্রজ্ঞা” সেই রহস্যকে মানবসমাজের জন্য দিকনির্দেশনা হিসেবে ব্যাখ্যা করে।
এভাবে এই পরিশিষ্ট পাঠকের কাছে একটি শক্তিশালী বার্তা পৌঁছে দেয়:
সত্যিকার ধর্ম কোনো রীতিনীতি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—এটি এক যাত্রা, এক উত্তরণ। ভ্রান্তি থেকে প্রজ্ঞায়, বিভাজন থেকে ঐক্যে, ব্যক্তিগত সংকীর্ণতা থেকে মহাজাগতিক দৃষ্টিতে উত্তরণই মানুষের সত্যিকার ধর্ম।
ফলে এই বইয়ের সমাপ্তি কেবল একটি দর্শনীয় চিন্তার সমাপ্তি নয়; এটি পাঠকের সামনে এক নতুন পথ খুলে দেয়—এক এমন পথ যা তাকে ব্যক্তি থেকে মহাবিশ্বের নাগরিক হতে আহ্বান জানায়।
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই