রিচার্ড ডকিন্সের “দ্যা গড ডিলিউশন” ও “ভ্রান্তি থেকে প্রজ্ঞা” বই দুটির তুলনামূলক আলোচনা
রিচার্ড ডকিন্সের “দ্যা গড ডিলিউশন” ও “ভ্রান্তি থেকে প্রজ্ঞা” বই দুটির তুলনামূলক আলোচনা
আধুনিক বৌদ্ধিক বিতর্কে রিচার্ড ডকিন্সের “The God Delusion” নিঃসন্দেহে একটি মাইলফলক গ্রন্থ। ডকিন্স ঈশ্বরের ধারণাকে কেবল সাংস্কৃতিক নির্মাণ (cultural construct) হিসেবে দেখেন, যা তার ভাষায় এক ধরনের “cognitive delusion।” তিনি ঐতিহ্যবাহী ধর্মতাত্ত্বিক যুক্তি—cosmological, teleological এবং ontological argument—সমালোচনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে মহাবিশ্বের অস্তিত্ব বা জটিলতা ব্যাখ্যা করতে কোনো অতিপ্রাকৃত সত্তার প্রয়োজন নেই। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি মূলত বৈজ্ঞানিক প্রাকৃতিকতাবাদ (scientific naturalism) এবং প্রমাণনির্ভর যুক্তিবাদ (empirical rationalism)-এর উপর দাঁড়িয়ে। এর ফলে তাঁর বই ধর্মীয় বিশ্বাসকে একেবারে প্রান্তিক করে দিয়ে মুক্তচিন্তা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বৈজ্ঞানিক মনোভাবকে মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ হিসেবে প্রস্তাব করে।
কিন্তু “ভ্রান্তি থেকে প্রজ্ঞা” গ্রন্থটি একেবারেই ভিন্ন দর্শন বহন করে। সমকালীন দার্শনিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, লেখক এক ধরনের নৈতিক-আধ্যাত্মিক পুনর্জাগরণের আহ্বান জানাচ্ছেন। এখানে ঈশ্বরকে anthropomorphic রূপে কল্পনা করা হয়নি; বরং তিনি মহাবিশ্বের অন্তর্নিহিত স্বয়ংক্রিয় নৈতিক শৃঙ্খলা ও পুনর্গঠনক্ষমতার প্রতীক। এই দৃষ্টিভঙ্গি স্পিনোজার Deus sive Natura (“ঈশ্বর অর্থাৎ প্রকৃতি”) ধারণার সঙ্গে গভীর সাদৃশ্যপূর্ণ, যেখানে ঈশ্বরকে ব্যক্তিসত্তা নয় বরং মহাবিশ্বের আইন ও নিয়মের সমষ্টি হিসেবে দেখা হয়। লেখকের ভাষায়, প্রকৃত পরমকর্তা বা আল্লাহ সেই universal auto-healing, all-good system—যে ব্যবস্থা অবিচ্ছিন্নভাবে ভারসাম্য রক্ষা করে, অন্যায়ের প্রতিফলন ঘটায়, এবং ন্যায়ের দিকে সৃষ্টিকে ধাবিত করে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি আইনস্টাইনের cosmic religious feeling-এর সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ। আইনস্টাইন বলেছিলেন, প্রকৃত ধর্মীয় অভিজ্ঞতা হলো মহাবিশ্বের শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্যের প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধাবোধ। “ভ্রান্তি থেকে প্রজ্ঞা” ঠিক এই ধরণের এক অনুভূতির দিকে আহ্বান জানায়, তবে এখানে আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা নৈতিক দায়িত্ববোধের সাথে মিশে যায় এবং ব্যক্তিকে বৈশ্বিক মানবিকতার পথে পরিচালিত করে।
ফলে ডকিন্সের দর্শন যেখানে মূলত ধ্বংসাত্মক সমালোচনা (deconstructive critique)—ধর্মের ভুল ধারণা ও কুসংস্কার ভেঙে ফেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ—এই গ্রন্থ সেখানে একটি নির্মাণমূলক বিকল্প পথ (constructive alternative) প্রস্তাব করে। এটি কেবল ধর্ম-বিরোধী নয়, বরং ধর্ম, দর্শন ও রাজনীতির ভ্রান্তি অতিক্রম করে মানুষকে মহাজাগতিক সত্যের সাথে পুনর্মিলনের পথে চালিত করে। বিশেষজ্ঞরা লক্ষ্য করেছেন যে, এই বই পাঠককে কেবল সংশয়ের পথে নিয়ে যায় না; বরং এক ধরণের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক রূপান্তর ঘটাতে চায়, যা ব্যক্তিগত এবং সামষ্টিক উভয় স্তরে কার্যকর।
গবেষকরা বলছেন, “ভ্রান্তি থেকে প্রজ্ঞা” এক অর্থে একটি মেটা-ন্যারেটিভ—যা ধর্মীয় ও দার্শনিক ইতিহাসকে পুনরায় ব্যাখ্যা করে মানবতাকে কেন্দ্র করে এক বৈশ্বিক নৈতিক দর্শনের ভিত্তি স্থাপন করে। এটি পাঠককে আমন্ত্রণ জানায় এক নতুন সামাজিক চুক্তির (new social contract) দিকে, যেখানে মানুষ, প্রকৃতি এবং সৃষ্টিকর্তা—তিনের সম্পর্ক পুনর্নির্মিত হয় ন্যায়, প্রেম ও করুণার অটল সূত্রের উপর ভিত্তি করে।
এভাবে, ডকিন্স যেখানে ঈশ্বরকে পরিত্যাগের মাধ্যমে মুক্তি দেখেন, এই গ্রন্থ সেখানে প্রকৃত ঈশ্বরকে আবিষ্কারের মাধ্যমে মুক্তির পথ দেখায়। এটি ধর্মের ভ্রান্তি ভেঙে দেয়, কিন্তু তার ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে এক নতুন মানবিক ও নৈতিক সভ্যতার স্বপ্ন নির্মাণ করে।
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই