(১) মানুষ কেন বিবেক হারায়?
মানুষ কেন বিবেক হারায়?
– ব্যক্তিগত স্বার্থ, সামাজিক প্রভাব, ধর্মীয় রীতি এবং অন্ধ আনুগত্যের সমন্বিত বিশ্লেষণ
মানুষের জন্মগতভাবে কিছু ইন্দ্রিয়, আবেগ, এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা রয়েছে। দৃষ্টি, শ্রবণ, ঘ্রাণ, স্বাদ ও স্পর্শের মতো সংবেদনশীল অঙ্গগুলো দিয়ে মানুষ অনুভব করে, আর মস্তিষ্ক এবং মন এই অভিজ্ঞতাগুলো থেকে common sense বা স্বাভাবিক বিচারবোধ গড়ে তোলে। কিন্তু ইতিহাসের এক দীর্ঘ সময়ে দেখা গেছে, মানুষ স্বাভাবিক বিবেক গঠনের আগেই বিভিন্ন ধর্মীয় রীতি, সামাজিক বিধি এবং মতাদর্শের দ্বারা শাসিত হয়েছে। ফলে তার বিচারবোধ পরিণত হওয়ার আগেই এক প্রকার আবেশিত বিবেক (conditioned conscience) তৈরি হয়ে গেছে—যেখানে প্রশ্নহীন আনুগত্যকে গুণ হিসেবে দেখা হয়।
ধর্মীয় রীতিনীতির প্রভাব
শৈশব থেকেই মানুষকে শেখানো হয়—নির্দিষ্ট বিশ্বাসকে মানতে হবে, নির্দিষ্ট আচরণকে পালন করতে হবে, আর তা না করলে ঈশ্বরের শাস্তি বা স্বর্গ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয় রয়েছে।
• এই আবশ্যিক বিশ্বাসের আবেশে স্বাভাবিক ও স্বাধীন বিবেকের বিকাশ বন্ধ হয়ে যায়।
• মানুষ তখন ধর্মের নামে এমন কাজও স্বাভাবিক মনে করে, যা প্রকৃত বিবেক কখনও মেনে নিত না—যেমন পশুবলি, পশু কোরবানি, এমনকি honor killing।
• ফলস্বরূপ, সত্য-মিথ্যা বা ন্যায়-অন্যায়ের বিচার আর মুক্তভাবে হয় না; ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ যা বলেছে তাই পরম সত্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
সামাজিক রীতি ও প্রথার বাঁধা
শুধু ধর্ম নয়, সমাজের প্রচলিত প্রথাও স্বাধীন বিবেকের বড় প্রতিবন্ধকতা।
• সমাজ যেটিকে গ্রহণযোগ্য মনে করে, মানুষ সেটিকে বিবেকের সঙ্গে না মিলিয়েই সত্য ধরে নেয়।
• কুসংস্কার, বর্ণভেদ, নারী-পুরুষ বৈষম্য ইত্যাদি সামাজিক রীতির প্রতি অন্ধ আনুগত্য মানুষকে প্রশ্নহীন করে তোলে।
• ফলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো দূরের কথা, অনেকে অন্যায়ের সহযোগী হয়ে ওঠে।
মতবাদ ও দর্শনের সীমাবদ্ধতা
দর্শন ও মতবাদ মানুষকে চিন্তার জগতে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু অন্ধভাবে কোনো মতবাদ অনুসরণ করলে সেটিও মুক্ত চিন্তার পথে বাধা সৃষ্টি করে।
• একদিকে যেমন ধর্মীয় গোঁড়ামি বিবেককে গ্রাস করে,
• অন্যদিকে মতাদর্শিক গোঁড়ামিও মানুষকে সংকীর্ণ করে তোলে।
• তখন ব্যক্তি আর প্রশ্ন তোলে না—কারণ সে মনে করে, তার মতাদর্শ বা দর্শনই চূড়ান্ত সত্য।
রাজনৈতিক গুরুর অন্ধ আনুগত্য
রাজনীতিতেও একই ঘটনা ঘটে।
• মানুষ যখন কোনো রাজনৈতিক নেতাকে বা দলকে অন্ধভাবে সমর্থন করে, তখন নেতার ভুল, দুর্নীতি এমনকি পৈশাচিক কাজকেও বিবেকসম্মত মনে করে।
• ব্যক্তি নিজের বিবেক দিয়ে বিচার না করে নেতার বা দলের নির্দেশকেই সত্য ধরে নেয়।
ফলাফল: বিবেকের অবক্ষয়
• এভাবে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা, সামাজিক রীতি, মতবাদ এবং রাজনৈতিক আনুগত্যের মিলিত প্রভাবে মানুষ নিজের স্বাভাবিক বিচারবোধ হারিয়ে ফেলে।
• জন্মগত মানবিক বিবেকের পরিবর্তে একটি আবেশিত বিবেক তৈরি হয়, যা বাইরের চাপ বা ভয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
• এমন মানুষ কেবল ব্যক্তিগত স্বার্থের দাস হয় না, বরং অন্যের স্বার্থ রক্ষার জন্যও নিজের মানবিকতাকে বিসর্জন দেয়।
সমাধান কোথায়? শিক্ষা, নাকি আত্মজিজ্ঞাসা?
• শিক্ষা অবশ্যই প্রয়োজন, তবে শুধু তথ্যভিত্তিক শিক্ষা নয়—প্রশ্ন করার, বিশ্লেষণ করার, এবং মানবিক বিচার করার ক্ষমতা শেখানো দরকার।
• সবচেয়ে বড় সমাধান আত্মজিজ্ঞাসা—নিজেকে জিজ্ঞাসা করার সাহস।
• “আমি যা বিশ্বাস করছি, তা কি সত্যিই আমার বিবেকের সিদ্ধান্ত, নাকি চাপিয়ে দেওয়া ধারণা?”—এই প্রশ্ন মানুষকে ধীরে ধীরে মুক্ত করতে পারে।
সত্যিকারের বিবেক জন্মায় তখনই, যখন মানুষ ভয়, চাপ ও আবেশের বাইরে গিয়ে প্রকৃত মানবিকতা ও যুক্তি দিয়ে বিচার করতে শেখে।
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই