মানুষ কেন বিবেক হারায়?
মানুষ কেন বিবেক হারায়?
– ব্যক্তিগত স্বার্থ, সামাজিক প্রভাব, ধর্মীয় রীতি এবং অন্ধ আনুগত্যের বিশ্লেষণ
মানুষ জন্মগতভাবে সংবেদনশীল ও বিবেকসম্পন্ন প্রাণী। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মানুষ পৃথিবীকে অনুভব করে, মস্তিষ্ক ও মন সেই অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ করে এবং ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে তার স্বাধীন বিচারবোধ বা common sense। কিন্তু মানবসভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাসে দেখা যায়—মানুষের এই স্বাভাবিক বিবেকের বিকাশ প্রায়ই ধর্মীয় রীতি, সামাজিক প্রথা, মতাদর্শ এবং রাজনৈতিক আনুগত্যের দ্বারা ব্যাহত হয়েছে। এর ফলে মানুষের মধ্যে জন্ম নেয় আবেশিত বিবেক, যা বাইরের চাপ বা কর্তৃত্বের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, এবং সে তার নিজস্ব মানবিক বিচারক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
১. ব্যক্তিগত স্বার্থ বনাম মানবিক দায়িত্ব
প্রথমেই প্রশ্ন আসে—মানুষ কেন নিজের স্বার্থকে মানবিক দায়িত্বের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়?
• স্বার্থের টান মানুষকে নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত করে। যখন ব্যক্তি নিজের সাফল্য, ক্ষমতা বা সম্পদ অর্জনের জন্য অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে, তখন তার বিবেক ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে পড়ে।
• সময়ের সাথে সাথে এ ধরনের মানুষ ভুলকেই স্বাভাবিক মনে করতে শুরু করে, কারণ স্বার্থের জয় তাদের কাছে ন্যায়ের চেয়েও জরুরি হয়ে ওঠে। মানুষের প্রকৃত বিবেক তখনই টিকে থাকতে পারে, যখন ব্যক্তিগত স্বার্থ ও মানবিক দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হয়।
২. ধর্মীয় রীতি ও আবেশিত বিবেক
শৈশব থেকেই মানুষকে শেখানো হয়—নির্দিষ্ট বিশ্বাসকে মানতে হবে, তা না করলে ঈশ্বরের শাস্তি নেমে আসবে বা স্বর্গ থেকে বঞ্চিত হতে হবে।
• এই ভয়ভিত্তিক শিক্ষা মানুষকে প্রশ্ন তোলার ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করে।
• স্বাভাবিক বিবেকের পরিবর্তে এক প্রকার আবেশিত বিবেক তৈরি হয়, যেখানে ন্যায়-অন্যায়ের বিচার ধর্মীয় কর্তৃত্বের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। ফলস্বরূপ মানুষ এমন কাজকেও স্বাভাবিক মনে করে যা মানবিক বিবেক কখনও সমর্থন করতে পারে না—
• পশুবলি বা পশু কোরবানি
• ধর্মের নামে honor killing
• অন্যান্য নৃশংস রীতির অনুকরণ
ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে মানবিক করা, কিন্তু অন্ধ আনুগত্য ও ভয় সেটিকে উল্টো পথে ঠেলে দিয়েছে।
৩. সামাজিক রীতি ও প্রথার বাঁধা
ধর্মের পাশাপাশি সমাজও মানুষের বিবেককে নিয়ন্ত্রণ করে।
• প্রচলিত প্রথা বা সামাজিক রীতি যে জিনিসকে গ্রহণযোগ্য মনে করে, মানুষ সেটিকেই সত্য ধরে নেয়।
• কুসংস্কার, বর্ণভেদ, নারী-পুরুষ বৈষম্য—এসবের বিরুদ্ধে স্বাধীন বিবেকের প্রশ্ন তোলার ক্ষমতা দমন করা হয়।এভাবে সমাজে “ভদ্রলোকের মানদণ্ড” তৈরি হয়, যেখানে মানুষ নিজের মানবিক বিচারবোধ নয়, বরং অন্যের স্বীকৃতিকে বেশি গুরুত্ব দেয়।
৪. মতবাদ ও দর্শনের গোঁড়ামি
দর্শন মানুষের চিন্তাশক্তিকে প্রসারিত করার কথা, কিন্তু
• কোনো মতবাদ বা দর্শন যখন চূড়ান্ত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়,
• তখন তা মানুষের স্বাধীন চিন্তার পরিবর্তে গোঁড়ামিতে রূপ নেয়। ফলস্বরূপ মানুষ নিজের যুক্তি ও বিবেক দিয়ে বিচার না করে অন্ধ অনুসারীতে পরিণত হয়।
৫. রাজনৈতিক আনুগত্য ও বিবেকহীনতা
রাজনীতির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে।
• মানুষ যখন কোনো নেতা বা দলকে অন্ধভাবে সমর্থন করে, তখন সেই নেতার ভুল, দুর্নীতি কিংবা পৈশাচিক কর্মকাণ্ডও তার কাছে ন্যায্য বলে মনে হয়।
• বিবেক আর কাজ করে না—কারণ ব্যক্তি মনে করে, “আমার নেতা যা করেন, তা-ই সঠিক।” এটি শুধু নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটায় না, বরং সমাজকে অমানবিক করে তোলে।
৬. সমাধান কোথায়: শিক্ষা, নাকি আত্মজিজ্ঞাসা?
• শিক্ষা: সঠিক শিক্ষা মানুষকে যুক্তিবাদী ও প্রশ্নপ্রবণ করে তুলতে পারে। তবে শুধুই তথ্যভিত্তিক শিক্ষা নয়—প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষা এবং সমালোচনামূলক চিন্তার অনুশীলন।
• আত্মজিজ্ঞাসা: সবচেয়ে বড় সমাধান হলো নিজেকে প্রশ্ন করার সাহস।
• “আমি যা বিশ্বাস করি, তা কি সত্যিই আমার বিবেকের সিদ্ধান্ত, নাকি চাপিয়ে দেওয়া ধারণা?”
• “আমি কি ভয়ে বা প্রলোভনে সত্যকে এড়িয়ে যাচ্ছি?”
যখন মানুষ বাইরের চাপ, ভয় এবং আবেশের বাইরে গিয়ে মানবিকতা, যুক্তি এবং করুণার আলোকে বিচার করতে শেখে, তখনই জন্ম নেয় সত্যিকারের বিবেক।
উপসংহার: ভ্রান্তি থেকে প্রজ্ঞার পথে
মানুষের বিবেক হারানোর মূল কারণ হলো অন্ধ আনুগত্য, ভয়, প্রলোভন এবং সামাজিক চাপ।
• ধর্মীয় আবেশ মানুষকে ঈশ্বরের নামে নৃশংস হতে শেখায়।
• সামাজিক রীতি মানুষকে প্রশ্নহীন ভদ্রলোক বানায়।
• মতাদর্শ মানুষকে স্বাধীন চিন্তা থেকে বঞ্চিত করে।
• রাজনৈতিক আনুগত্য মানুষকে নেতার অপরাধের সহযোগী বানায়।
এই ভ্রান্তির পথ থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায়—শিক্ষা, প্রশ্ন করার সাহস, এবং আত্মজিজ্ঞাসা। এভাবেই মানুষ ভ্রান্তি থেকে প্রজ্ঞার পথে যাত্রা শুরু করতে পারে।
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই